সেই কবিতা পড়ে আবেগের বশে যদি কেউ আজ কপোতাক্ষ নদ দেখতে যান, তাহলে হতাশ হয়েই তাকে ফিরে আসতে হবে।
কপোতাক্ষের কোথাও শুকনো খটখটে, আবার কোথাও সরু খালের মতো জমে আছে পানি আর তার ওপর ভর করেছে রাজ্যের কচুরিপানা।
"এই নদীর পানি আয়নার মতো চকচক করত। গভীরতা ছিল কোন জায়গায় ১৫ হাত, কোন জায়গায় ২০ হাত। একটা পাতা পড়লে স্রোতে টাইনে নিয়ে যাইত। জোয়ার-ভাটা চলত"।
বলেন ষাটোর্ধ্ব জাবেদ আলী গাজী। ধীরে ধীরে কপোতাক্ষ নদের এই পরিবর্তন তিনি নিজ চোখে দেখেছেন।
"কি দেখলাম আর কি হইলো। আর মাছ তো খাতি পারলাম না। ট্যাংরা মাছ, বোইল মাছ, আইড় মাছ, কতরকমের মাছ ছিল এই নদীতে।"
জাবেদ আলী গাজীর ভাষ্যে ২০ বছর আগেও এই নদীতে স্রোত ছিল, ছিল জোয়ার-ভাটার খেলা। কিন্তু কপোতাক্ষের দিকে তাকালে এখন আর সেকথা বিশ্বাস করাই কঠিন।
কপোতাক্ষের পাশেই বাড়ি শফিকুল ইসলামের। সত্তরোর্ধ্ব প্রবীণ মি. ইসলাম কাঠের ব্যবসা করেন। নিজ বাড়ির সামনে কাজ করতে করতে স্মৃতি রোমন্থন করে তিনি বলেন, একসময় তার বাড়ির সামনেই ছিল স্টিমারঘাট। সেই ঘাটে কলকাতা থেকে পণ্যবাহী জাহাজ এসে ভিড়তো, বিকেলে হাজার হাজার মানুষ বেড়াতে আসতেন নদের পাড়ে।
কিন্তু যে নদ নিয়ে মানুষের এত স্মৃতি, এর সৌন্দর্য্যের এত বর্ণনা পলি জমে সেই নদী এভাবে ভরাট হয়ে গেল কিভাবে?
কপোতাক্ষ নদ
ছবির ক্যাপশান, কপোতাক্ষ নদ থেকে একসময় প্রচুর মাছ পাওয়া যেত, কিন্তু এখন দিনভর ঘুরেও ছোটমাছের বাইরে কিছু পাওয়া কঠিন
কপোতাক্ষ নদ নিয়ে গত প্রায় ২০ বছর যাবত আন্দোলন করছে যশোরের কপোতাক্ষ বাঁচাও আন্দোলন। সংগঠনটির আহ্বায়ক অনিল কুমার বিশ্বাস বলছেন, কপোতাক্ষ নদকে বাঁচানোর কথা যখন আসে, তখন অনেকেই এটি ভরাট হওয়ার মূল কারণটি এড়িয়ে যান।
"নদীর আপস্ট্রিম (উজান) সংযোগ বন্ধ হয়ে আছে এক'শ বছর ধরে। উৎসমুখ যদি বন্ধ থাকে তাহলে সেটি আর নদী বলা যায় না, এটি বদ্ধ জলাশয়। যেহেতু আপস্ট্রিম সংযোগ নেই, তাই সাগর থেকে ভাসমান পলি এসে ধীরে ধীরে নদীটিকে ভরাট করে ফেলেছে। "
মি. বিশ্বাস বলছেন, শিল্পপ্রতিষ্ঠান বা সেতু নির্মাণ করতে গিয়ে উজানের সাথে সংযোগ বন্ধ করার মাধ্যমে কপোতাক্ষকে অনেক আগেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয়েছে। এরপর বিভিন্ন সময়ে বাঁধ দিয়ে নদী কাটার চেষ্টা, পোলডার, বাঁধ, বেড়িবাঁধ তৈরি করে কপোতাক্ষ ভরাটের এই প্রক্রিয়া আরো দ্রুততর হয়েছে।
সঠিক পরিকল্পনার যে অভাব ছিল সেটি স্বীকার করছে পানি উন্নয়ন বোর্ডও।
বর্তমানে কপোতাক্ষের প্রায় ৮৪ কি. মি. দৈর্ঘ্যে খননকাজ চলছে এবং একইসাথে টাইডাল রিভার ম্যানেজম্যান্ট বা টিআরএম পদ্ধতিতে পলি সরানোর কাজও চলছে।
যশোরে পানি উন্নয়ন বোর্ডের উপ বিভাগীয় প্রকৌশলী শওকত হোসেন বলছেন, উজানে মাথাভাঙ্গা নদীর সাথে ভৈরবের সংযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বারবার ভরাট হচ্ছে কপোতাক্ষ।
কপোতাক্ষ নদ
"মাথাভাঙ্গা নদী দর্শনা থেকে ভারতে চলে গেছে। সেখানে যে ছোট একটি খাল ছিল, সেটিও ভারত দিয়ে ঘুরে আসায় তারা সেটি বন্ধ করে দিয়েছে। বন্ধ করে দেয়ায় এখন বৃষ্টির পানি ছাড়া ভৈরব বা কপোতাক্ষে পানির আর কোন উপায় নেই। এই নদীতে যখন স্রোত ছিল, তখন বঙ্গোপসাগর থেকে ৮-১০ কিলোমিটার পর্যন্ত পলি আসত। কিন্তু সেই পলি এখন ১০০ কিলোমিটার উপরে চলে আসছে।"
কপোতাক্ষ ভরাটের ফলে বছরের পর বছর কপোতাক্ষের পাড়ে যশোরের কেশবপুর, মণিরামপুর এবং সাতক্ষীরা জেলার কিছু এলাকায় প্রতিবছর পুরো বর্ষাজুড়ে তৈরি হয় জলাবদ্ধতা।
বর্ষার সময়ে ভিটেমাটি ছেড়ে অনেকেই আশ্রয় নেন ভিন্ন কোন স্থানে আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে।
খননকাজ এবং টিআরএম পদ্ধতি চালু রাখার কথা বললেও এর মাধ্যমে যে কপোতাক্ষকে আগের রূপে ফেরানো যাবে না, সেটি স্বীকার করছে পানি উন্নয়ন বোর্ডও।
অনিল বিশ্বাস বলছেন, এজন্যে উজানের সাথে কপোতাক্ষের সংযোগ তৈরি করা প্রয়োজন।
"খনন করলে কিছু খনন হবে, কয়েক বছর থাকবে তারপর আবার পলি এসে ভরাট হয়ে যাবে। সেজন্যে আমরা বলছি উজানে নদী সংযোগটি দিলে পদ্মার পানিটি আমরা পাবো এবং পদ্মার পানিটি পেলে নদী স্বয়ংক্রিয়ভাবেই খনন হয়ে যাবে।"
পানি উন্নয়ন বোর্ড বলছে, মাথাভাঙ্গা নদীর সাথে ভৈরব নদীর একটি সংযোগ তৈরি করে উজানের পানি ভৈরব এবং কপোতাক্ষে নিয়ে আসার একটি প্রকল্প সরকারী দপ্তরে অনুমোদনের অপেক্ষায় রয়েছে। তবে আজো সেই অনুমোদন না পাওয়ায় নদের অবস্থা - শুকনো খরা মাটি ।
বর্তমান চিত্র |
তবে গুরুত্বপূর্ণ হলেও দীর্ঘদিন যাবত উজান থেকে ভৈরব এবং তার শাখা নদ কপোতাক্ষে পানি সরবরাহের সেই প্রস্তাবটি ফাইলবন্দী হয়ে রয়েছে বলে অভিযোগ আন্দোলনকারীদের।
কপোতাক্ষকে আগের রূপে কতটা ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব সেটি হয়তো বলা যাবে না, কিন্ত এই নদকে যদি আবার পুনরুজ্জীবিত করতে হয়, তবে এটিই হয়তো একমাত্র উপায়।