মোদির ভারত: হিন্দুত্ববাদ ও সাম্প্রদায়িকতার নয়া উত্থান

২০১৯ সালে ভারতে লোকসভা নির্বাচন। এ নির্বাচনকে ঘিরে চলছে রাজনৈতিক নানা তৎপরতা। ২০১৪ সালের মতোই হিন্দুত্ববাদের স্লোগান দিয়ে ক্ষমতায় আসার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে বিজেপি সরকার। ক্ষমতায় বসার পর থেকেই একনীতিতে চলছে দলটি। ভারতজুড়ে হিন্দুত্ববাদের বিস্তার, জাতীয়তা রক্ষার নামে হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠা, মুসলিম, খ্রিস্টান ও সংখ্যালঘু সব গোষ্ঠীর ওপর নানাবিধ নির্যাতন, গো-রক্ষার নামে মানুষ হত্যা, ঘর ওয়াপেসির নামে জোরপূর্বক ধর্মান্তকরণ, লাভ জিহাদের নামে মিথ্যা মামলা ও হয়রানি এগুলো বিজেপি সরকারের হিন্দুত্ববাদী প্রজেক্টের কিছু নমুনামাত্র। সম্প্রতি ভারতের বিভিন্ন জেলা ও থানার ঐতিহাসিক ইসলামি ঐতিহ্যঘেঁষা নাম বদলে ফেলার কাজও শুরু করেছে দলটি। আর এসবের নেতৃত্বে রয়েছে ভারতের সবচেয়ে বড় হিন্দু জাতিয়তাবাদী গোষ্ঠী হিন্দুত্ববাদী জোট সংঘ পরিবার।



বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পর তার দল বিজেপি তথা সংঘ পরিবারের মূল দর্শন হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠার প্রয়াস নিয়ে দেশজুড়ে তুলকালাম অবস্থা সৃষ্টি হয়। গোমাংস খাওয়া বা নিছক গো-মাংস খেয়েছে এই ধারণার উপর ভিত্তি করে মানুষ এমনকি শিশুদের পর্যন্ত হত্যা করা হয়। ইউনিভার্সিটি-কলেজগুলোতে ছাত্ররা নিগৃহীত হয়। সামাজিক ন্যায়বিচারের পক্ষে কাজ করতে এবং কুসংস্কার দূর করতে গিয়ে বুদ্ধিজীবীরা হত্যা ও গণ-গ্রেফতারের শিকার হন।

হিন্দুত্ববাদের নয়া উত্থান


হিন্দুধর্ম আর হিন্দুত্ববাদ এক নয়। যে হিন্দুত্ববাদের নীতি নিয়ে মোদি সরকার দেশ চালাচ্ছে, এর তাত্ত্বিক গুরু হিন্দু জাতীয়তাবাদী নেতা ও হিন্দু স্বার্থের প্রবক্তা বিনায়ক দামোদার সাভারকার। ১৯২৩ সালে তিনি তার এই তত্ত্ব প্রকাশ করেন। তার ‘হিন্দুত্ববাদ’ শব্দটা ভারতের সর্ববৃহৎ হিন্দু জাতীয়তাবাদী জোট ‘সংঘ পরিবার’ ও এর অঙ্গ সংগঠনগুলো বেশ জনপ্রিয় করে তোলে। আর এর বাস্তবিক প্রয়োগ হচ্ছে মোদি সরকার ক্ষমতায় আসার পর।

যে হিন্দু নয় বা হিন্দুদের আধিপত্য মেনে নেয় না, তার কোন স্থান হিন্দুত্ববাদে নেই। হিন্দুধর্ম চরিত্রগতভাবে গণতান্ত্রিক এবং এমন এক বহুদলীয় ও বৈচিত্র্যময় সমাজের সমার্থক, যা অন্যান্য গোষ্ঠীর মতামতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। অন্যদিকে হিন্দুত্ববাদ মনোলিথিক সমাজে বিশ্বাসী, যেখানে হিন্দু ধর্মীয় রীতিনীতি, আচার, প্রথা ও ঐতিহ্যের বাইরে অন্য কিছু থাকবে না। ভারতে প্রায় ৮২ শতাংশ মানুষ হিন্দুধর্মের অনুসারী। তবে তারা সবাই হিন্দুত্ববাদের সমর্থক নয়। জনগোষ্ঠীর ক্ষুদ্র একটি অংশই মাত্র হিন্দুত্ববাদের সমর্থক।

মোটকথা হিন্দুধর্ম এক অরাজনৈতিক জীবনধারা। এর কোন সংগঠন নেই, কাঠামো নেই, প্রাতিষ্ঠানিক গঠনতন্ত্র নেই। অন্যদিকে, হিন্দুত্ববাদ ধর্মীয় ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের এক জটিল মিশ্রণ থেকে সৃষ্ট একটি রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী মতবাদ। এটা ধর্মও নয়, আবার জীবনধারাও নয়। এটা একটা সাম্প্রতিক ও আগ্রাসী রাজনৈতিক দর্শন, যার মধ্যে জিঙ্গোইজম বা উগ্র স্বদেশপ্রেম, উৎকট জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় সত্তা জটিলভাবে মিশে আছে। হিন্দুত্ববাদ জাতীয়তাবাদকে একটা নির্দিষ্ট ধর্মীয় বিশ্বাস ও আনুগত্যের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলে এবং ধর্মীয় স্বাধীনতার বিপক্ষে দাঁড়ায়। আর এসব সবকিছুরই প্রমাণ দিয়েছে মোদির নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার। ২০১৪ সালে ক্ষমতার আসার পর থেকে বিজেপি একের পর এক সাম্প্রাদায়িক ঘটনার জন্ম দিয়েছে৷ ফলে মোদির যুগকে ভারতে হিন্দুত্ববাদের নব উত্থানই বলা যেতে পারে।

কী কী ঘটেছে মোদির আমলে?


ভারত রাষ্ট্রীয়ভাবে ধর্মনিরপেক্ষ হলেও মোদির আমলে এর প্রমাণ পায়নি বিশ্ব। হিন্দু ধর্ম ছাড়া সকল ধর্মের মানুষই মোদির আমলে নিষ্পেষিত ও নির্যাতিত হয়েছে, হচ্ছে। বিশেষ করে মুসলিমদের ওপর নির্যাতনের নতুন নতুন রুপ বিশ্ব দেখেছে এই সরকারের আমলে। সুকৌশলে, সুচিন্তিত পরিকল্পনা করে মুসলিমদের ওপর নির্যাতন চালিয়েছে তার দল। শুধুমাত্র গোমাংস খাওয়ার দোহাই দিয়ে মানবতার ইতিহাসের জঘন্যতম কাজটি করেছে সংঘ পরিবার। একটা শিশুর জীবনও রক্ষা পায়নি এই তথাকথিত গো-রক্ষকদের হাত থেকে।

উত্তরপ্রদেশ বিধানসভার নির্বাচনে বিজেপির বিপুল সাফল্যের পর যোগী আদিত্যনাথকে যখন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী করা হলো, তখনই স্পষ্ট বোঝা গেলো যে, ধর্মীয় মেরুকরণের রাজনীতি আরও আগ্রাসী হয়ে উঠছে৷ প্রদেশটিতে অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটছে নানাভাবে৷ কেন্দ্রে মোদী আর উত্তর প্রদেশে যোগী— এই দুইজনের নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদী সংঘ পরিবার ঝাঁপিয়ে পড়েছে গোটা দেশে৷ গো-রক্ষার নামে কট্টর মনোভাব, গরু পরিবহণকারীদের গণপিটুনি৷ তাতে মারাও গেছে চার পাঁচজন৷ তাঁদের অপরাধ, তাঁরা গরু বিক্রির জন্য লরিতে গরু নিয়ে যাচ্ছিলেন৷ রাস্তা ঘাটে নজর রাখছে ‘অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড’।

হিন্দুত্ববাদের পাহাড়াদার ‘অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড’

হিন্দুত্ববাদ প্রতিষ্ঠায় মোদির আমলে আত্মপ্রকাশ করে ‘অ্যান্টি-রোমিও স্কোয়াড’। নারীর সুরক্ষার লক্ষ্যে যোগী গঠন করেছেন ‘অ্যান্টি রোমিও স্কোয়াড’। পার্ক, স্কুল-কলেজের গেট, রাস্তা-ঘাটে ছেলে-মেয়ে একসঙ্গে দেখলেই চলছে জিজ্ঞাসাবাদ৷ এ সংগঠনটি গোটা দেশটাকে হিন্দুরাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে ভারতজুড়ে নৈরাজ্য চালিয়েছে। তরুণ-তরুণীদের একসঙ্গে বসে গল্প করতে দেখলেই ধরপাকড় করা হয়৷ সব ধর্মের লোকদেরই ‘বন্দে মাতরম’ গাইবার জন্য চাপ দেওয়া হয়৷ এমনকি সূর্য নমস্কারের ভঙ্গির সঙ্গে নামাজের মিল খুঁজে অযথা বিতর্ক তোলা হয়৷ উত্তরপ্রদেশে তরুণ-তরুণীদের মধ্যে সামাজিক মেলামেশা বন্ধ করতে রাজ্যে ‘হিন্দু যুব বাহিনী’ নামে একটি গ্রুপ তৈরি হয়েছে৷ এদের আস্পর্ধা শালীনতার গণ্ডি ছাড়িয়ে গেছে৷ তারাই উত্তরপ্রদেশের মিরাট শহরে এক মুসলিম বাড়িতে জোর করে ঢুকে এক দম্পতিকে হেনস্থা করে৷ যুব বাহিনীর মতে, তাঁরা নাকি দম্পতি নয়, ছেলে বন্ধু-মেয়ে বন্ধু৷ এই ধরনের আরেকটি ঘটনায় যুব বাহিনী একটি ছেলের মাথা মুড়িয়ে দেয়৷ তাঁর অপরাধ, তিনি তাঁর বান্ধবিকে নিয়ে ঘুরতে বেরিয়েছিলেন৷

উগ্র হিন্দু জাতীয়তাবাদীদের হাত থেকে রক্ষা পায়নি খ্রিষ্টান পাদ্রী ও চার্চগুলিও৷ কেরালা, মধ্যপ্রদেশ, উত্তরপ্রদেশ, গুজরাট, ছত্তিশগড় রাজ্যের চার্চগুলিতে ভাঙচুর চালিয়ে আগুন লাগায় সংঘ পরিবারের সদস্যরা৷ মারধর করে চার্চের পাদ্রী এবং নানদের৷ অভিযোগ, খ্রিষ্টানরা জোর করে বা লোভ দেখিয়ে নাকি হিন্দুদের, বিশেষ করে উপজাতি সম্প্রদায়ের লোকদের খ্রিষ্টান ধর্মে ধর্মান্তরিত করছিলো৷ তাই দেশে মুসলিমদের মতো খ্রিষ্টান জনসংখ্যাও বেড়ে যাচ্ছে৷ একটি চার্চে গৈরিক পতাকা ছিঁড়ে ফেলার অভিযোগে গির্জার পুরুষ ও মহিলা সদস্যদের দৈহিক হেনস্থা করা হয়৷

বাদ যায়নি বিদেশিরাও। আফ্রিকানদের ওপর হামলার ঘটনা জাতিবিদ্বেষের নগ্ন নজির৷ সম্প্রতি দিল্লির উপকণ্ঠে নয়ডায় নাইজেরীয় এক শিক্ষার্থী এবং কেনিয়ার এক তরুণীকে নিগ্রহের ঘটনায় নতুন দিল্লির আফ্রিকান দেশগুলির রাষ্ট্রদূতরা উত্তর প্রদেশের যোগী সরকার এবং কেন্দ্রের মোদী সরকারকেই মূলত দায়ী করেছেন৷ এই প্রসঙ্গে উঠে আসছে, গত দু’বছরে রুয়ান্ডা, উগান্ডা ও কংগোসহ অনেক আফ্রিকান দেশের নাগরিকদের উপর হিংসাত্মক বর্ণবাদী ঘটনার প্রসঙ্গ৷

২০১৫ অসহিষ্ণুতার বছর, লজ্জার বছর

২০১৫ সাল ভারতের ইতিহাসে চিহ্নিত হয়ে থাকবে অসহিষ্ণুতার বছর হিসেবে৷ ধর্মীয় এবং সাম্প্রদায়িক অসহিষ্ণুতা, আর তার থেকেও বিপজ্জনক এক রাষ্ট্রীয়, প্রশাসনিক অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটেছে বছরজুড়ে৷ আমির, শাহরুখ এবং সালমান খান৷ সারা দেশে অসম্ভব জনপ্রিয়তা তাদের৷ কিন্তু যেই তাঁরা দেশের অসহিষ্ণুতার পরিবেশ নিয়ে মুখ খুললেন, সঙ্গে সঙ্গে আসমুদ্রহিমাচল তাঁদের শত্রু হয়ে গেল৷ তাঁদের মুসলিম পরিচয়ের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে কটাক্ষ শুরু হয়ে গেল, ভারত যখন এতই খারাপ দেশ বলে মনে হচ্ছে, তাঁরা যেন এদেশ ছেড়ে দিয়ে পাকিস্তানে গিয়ে থাকেন৷

ফেসবুক-টুইটারে, হোয়াটসঅ্যাপে ফরোয়ার্ড করা রসিকতায় ব্যাঙ্গ-বিদ্রূপ থেকে শুরু করে অশালীন আক্রমণ শুরু হয়ে গেল তাঁদের বিরুদ্ধে৷ এতটাই, যে শাহরুখ খান তাঁর সর্বশেষ সিনেমার প্রচারে বেরিয়ে নিজের মন্তব্যের জন্য দুঃখপ্রকাশ করে বলতে বাধ্য হলেন যে, না, সবকিছু ঠিক চলছে ভারতে!

অথচ এমন কী বলেছিলেন তাঁরা? উত্তরপ্রদেশের দাদরি নামের এক অখ্যাত গ্রামে একজন বর্ষীয়ান মানুষকে ক্ষিপ্ত জনতা পিটিয়ে মেরে ফেলেছিলো স্রেফ এই সন্দেহে যে তিনি নিজের বাড়িতে গোমাংস খাচ্ছেন৷ এই যে সাম্প্রদায়িক জনরোষ, এর প্রেক্ষাপট তৈরি করে দিয়েছিল কিন্তু ভারতের মহারাষ্ট্র, হরিয়ানা এবং এমনকি জম্মু-কাশ্মীরের মতো মুসলিমপ্রধান রাজ্যে গোমাংসের ওপর জারি করা সরকারি নিষেধাজ্ঞা৷ তার পরেই কেন্দ্রে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোট সরকারের প্রচ্ছন্ন সমর্থনে গো-হত্যা বন্ধ করতে তৎপর হয়ে উঠেছিল হিন্দুত্ববাদীরা৷ ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষতার আদর্শ, তার সংবিধানে স্বীকৃত ব্যক্তিমানুষের অধিকার, কোনো কিছুরই তারা তোয়াক্কা করেনি৷ সেই প্রেক্ষিতেই শাহরুখ খান বলেছিলেন, ‘দেশ যেভাবে এক অন্ধকার সময়ের দিকে এগোচ্ছে, তা আরও পিছিয়ে দেবে ভারতকে৷’ তার প্রতিক্রিয়ায় তাঁকে শুনতে হল, তিনি ভারতে থাকলেও তাঁর হৃদয় রয়েছে পাকিস্তানে!

আরেক তারকা আমির খান তাঁর স্ত্রী কিরণ রাওয়ের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করে বলেছিলেন, ক্রমশ এমন পরিস্থিতি হচ্ছে যে ভবিষ্যতে ভারতে থাকা যাবে কিনা, ওদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ কী হবে, সে নিয়ে তাদের দুশ্চিন্তা হয়৷ সহজ সমাধান হিসেবে আমির খানকেও সারা দেশ পরামর্শ দিল, সপরিবার গিয়ে পাকিস্তানে থাকতে৷ এর বিপরীত অবস্থানে সুস্থ, যুক্তিবাদী, সহনশীল কণ্ঠ অবশ্যই ছিল, কিন্তু তা এতই ক্ষীণ যে তার কোনো প্রভাবই পড়ল না৷

অবশ্য অসহিষ্ণুতা সেই বিরুদ্ধবাদ নিয়েও।হিন্দুত্ববাদীদের বিরুদ্ধে কথা বলার জন্য কর্ণাটকে খুন হয়ে গেলেন যুক্তিবাদী লেখক অধ্যাপক এম এম কালবুর্গি, মহারাষ্ট্রে খুন হলেন নরেন্দ্র দাভোলকার, সমাজকর্মী গোবিন্দ পানসারে৷ প্রতিটি খুনেরই মূল সন্দেহভাজনের তালিকায় হিন্দুত্ববাদীরা, তবু তদন্তে চিরাচরিত দায়সারা গড়িমসির পরিচয় দিল প্রশাসন৷ প্রতিবাদে দেশের বিশিষ্ট, রাষ্ট্রীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত শিল্পী-সাহিত্যিক-চলচ্চিত্রকারেরা তাঁদের সরকারি খেতাব ফিরিয়ে দিতে শুরু করলেন৷ উলটে অভিযোগ উঠল, তাঁরা দেশে এবং বিদেশে সরকারকে হেয় করতে, রাজনৈতিক প্ররোচনায় পুরস্কার ফেরাচ্ছেন৷ পাল্টা শিল্পী-সাহিত্যিক-বুদ্ধিজীবীদের মিছিল করিয়ে প্রমাণ করার চেষ্টা চললো, এসবই আসলে দেশের ভাবমূর্তি কালিমালিপ্ত করার ষড়যন্ত্র৷

১৯৯৯ সালে ভারত সফরে এসেছিল পাকিস্তান৷ সেবার দু’দেশের ক্রিকেট ম্যাচ বানচাল করতে ফিরোজ শাহ কোটলার পিচ খুঁড়ে রেখেছিল হিন্দু মৌলবাদী দল শিব সেনা৷ তারপরও অবশ্য ম্যাচ হয়েছে৷ ২০০৬ সালে চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে পাকিস্তানের জয়পুর এবং মোহালির দু’টি ম্যাচেরও বিরোধীতা করেছিল শিব সেনা৷ সেবারও অবশ্য নির্বিঘ্নেই ম্যাচ হয়েছে৷ মুম্বাইতে প্রাক্তন পাক বিদেশমন্ত্রী খুরশিদ মাহমুদ কসুরির বই প্রকাশের অনুষ্ঠান বন্ধ করার হুমকি দিয়েছিল শিবসেনা৷ তাও বই প্রকাশ করা হল, সেই অপরাধে মুখে কালি লেপে দেওয়া হল লেখক-সমাজসেবী সুধীন্দ্র কুলকার্নির৷ সেই কালো মুখ নিয়েই সাংবাদিক সম্মেলন করলেন কুলকার্নি, প্রতিবাদ জানাতে৷ বলা হল, উনি নাকি রাজনীতি করছেন!

ভারতে এই অসহিষ্ণুতার মহড়া চলেছে ২০১৫ সালে পুরো বছরজুড়ে৷ যদি এই সবকটা ঘটনা বাদ দিলেও, ২০১৫ সাল কলঙ্কিত হয়ে থাকবে একটি অসভ্যতার জন্য৷ সারা দুনিয়া যাঁর গলার মাদকতায় আচ্ছন্ন, প্রবাদপ্রতিম সেই ওস্তাদ গুলাম আলিকে এবছরই মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে তিনি মুসলিম এবং শত্রু দেশ পাকিস্তানের লোক৷ তাই তিনি যতক্ষণ না পাকিস্তানের যাবতীয় কৃতকর্মের জন্য প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইবেন, তাঁকে ভারতে অনুষ্ঠান করতে দেওয়া হবে না! তারপর যদিও দিল্লি থেকে, কলকাতা থেকে সাদর আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে তাঁকে, কিন্তু অভিমানে মুখ ঘুরিয়েছেন তিনি৷ এ লজ্জা রাখার জায়গা নেই সহিষ্ণু ভারতের৷

মোদির ইসলামবিদ্বেষের ভায়াবহ চিত্র : তিন তালাক-বিরোধী আইন

চলতি বছরেই ভারত মুসিলমদের তিন তালাকের বিধান নিষিদ্ধ ঘোষণা করে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। সুপ্রিম কোর্ট মুসলিম সমাজে প্রচলিত তিন তালাক নিষিদ্ধ করার পর চারমাস পর বিজেপি নিয়ন্ত্রিত লোকসভা এ প্রথাকে অপরাধ আখ্যায়িত করে একটি বিল পাস করে। এ বিলটি এখন আইনে পরিণত হয়েছে। ফলে তিন তালাকের মাধ্যমে স্ত্রীদের পরিত্যাগকারী দোষী সাব্যস্ত মুসলিমদের তিন বছর পর্যন্ত জেল হতে পারে।

বিজেপির বিশ্বাস যে, এ আইন মুসলিমদের এই কাজ করা থেকে বিরত রাখবে এবং মোদী মুসলিম পার্সোনাল ল’ সংস্কার ও সামাজিক আইনকে চ্যালেঞ্জ করার কৃতিত্ব পাবেন। কিন্তু বহু মুসলিমই বিজেপির এ উদ্যোগের মধ্যে ভন্ডামি দেখতে পাচ্ছেন। এ বিলের বিষয় বহু লোকের মনেই এ বিশ্বাস সৃষ্টি করেছে যে, এটা আসলে মুসলিম নারীদের সাহায্য করার জন্য নয়, বরং মুসলিম পুরুষদের অপরাধের ধরন আরো বৃদ্ধি করা। এটা শুধু স্ত্রী নয়, যে কাউকেই অভিযোগ করার সুযোগ দেবে এবং সে ক্ষেত্রে স্বামী জেলে থাকলেও স্ত্রীকে ভরণপোষণ দিতে হবে।

লাভ জিহাদ প্রতিরোধের নামে মুসলিম বিরোধী সহিংসতা

বেশ কয়েকবছর ধরে, ভারতের হট টপিকগুলোর শীর্ষে আছে ‘লাভ জিহাদ’। লাভ জিহাদ বলে হিন্দুত্ববাদীরা বোঝায়, হিন্দু মেয়েদের মুসলমান পুরুষ বিয়ে করতে প্রলুব্ধ করার একটা মুসলমানি ষড়যন্ত্র। যার একমাত্র লক্ষ্য ভারতের হিন্দুদের ধর্মান্তরিত করা।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে নয়াদিল্লীর কাছে গাজিয়াবাদে এক মুসলিম যুবক ও এক হিন্দু নারীর বিবাহের প্রতিবাদে উগ্র হিন্দু কর্মীরা পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। তারা বলে এটা একটা চক্রান্ত। এদিকে কনের পরিবার বলে যে, বিবাহটি পরিবারের সম্মতিক্রমেই হয়েছে। কিন্তু বিজেপি কর্মকর্তারা বলেন, পরিবারগুলো আন্তঃধর্মীয় বিয়ের কোনো অনুমতি পায়নি। এটা হচ্ছে বলপূর্বক ধর্মান্তরের চক্রান্ত। কনে বিয়ের আগে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেনি। ভারতের সংবিধানে নাগরিকদের ধর্মান্তরের অনুমোদন রয়েছে। কিন্তু এ আইন আন্তঃধর্মীয় দম্পতিদেরকে হিন্দু মৌলবাদীদের হামলা ও হয়রানি থেকে রক্ষা করতে পারছে না। তারা হিন্দু মেয়েদের সাথে সম্পর্ক থাকার জন্য মুসলমানদের উপর সহিংস হামলা চালাচ্ছে।

২০১৭ সালের ডিসেম্বরে রাজস্থানের রাজাসামান্দে ৩৬ বছর বয়স্ক শম্ভুলাল রেগার আফরাজুল নামে ৫০ বছর বয়স্ক এক মুসলমানকে লাভ জিহাদের অভিযোগে হত্যা করে এবং তার দেহ পুড়িয়ে দেয়। রেগার দাবি করে যে, লাভ জিহাদ থেকে হিন্দু মেয়েদের রক্ষা করতে সে আফরাজুলকে হত্যা করেছে। পুলিশি তদন্তে দেখা যায়, রেগার অন্য এক মুসলমান যার সাথে এক হিন্দু নারীর প্রেম ছিল, তার জায়গায় সন্দেহবশত আফরাজুলকে হত্যা করেছে।লাভ জিহাদের বিরুদ্ধে প্রচারণা দিনদিনহয়ে উঠছে আরো বর্বর। ২০১৮ সালের জানুয়ারিতে উত্তরপ্রদেশের বাঘপতে একটি আদালতে তিন মুসলিম ভাইকে পেটানো হয় এ অপরাধে যে তাদের মধ্যে এক ভাই এক হিন্দু নারীকে বিয়ে করতে চেয়েছিল। হামলাকারীরা সবাই ছিল রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) অঙ্গ সংগঠন বিশ্ব হিন্দু পরিষদের লোক। আরএসএস সমর্থিত হিন্দু মৌলবাদীদের মতে, হিন্দু নারীর জন্য কোনো মুসলমানের ভালোবাসা খাঁটি হতে পারে না। এটা একটা প্রতারণা। এটি আসলে একটি নিরীহ মেয়েকে ইসলামে দীক্ষিত করার, সন্ত্রাসী গ্রুপে টানার ও ভারতকে একটি মুসলিম দেশে পরিণত করার চেষ্টা।

লাভ জিহাদের অভিযোগে নির্যাতনের শিকার হাদিয়ার ঘুরে দাঁড়ানোর গল্প

কেরালার এক হিন্দু তরুণী অখিলা দু’টি মুসলিম মেয়ের সাথে একটি ফ্ল্যাটে থাকত। ১৭’ সালের আগস্টে সে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে হাদিয়া নাম গ্রহণ করে এবং এক মুসলিমকে বিয়ে করে। ইসলামিক স্টেট অব ইরাক অ্যান্ড দি লেভান্ট ( আইএসআইএল আবার আইএসআইএস নামেও পরিচিত)-এ যোগ দিতে সিরিয়া যাবার পরিকল্পনার অংশ হিসেবে সে ইসলাম গ্রহণ করেছে বলে তার বাবা মামলা দায়ের করে। মামলার রায়ে কেরালা হাইকোর্ট এই বিয়েকে বাতিল ঘোষণা করে। হাইকোর্ট বলে, মেয়েটি দুর্বল ও অস্থির ছিল এবং তাকে প্রলুব্ধ করা হয় বলে সন্দেহ রয়েছে। বিয়ে তার জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত, তা শুধু তার বাবা-মার সক্রিয় সম্পৃক্ততার ভিত্তিতেই নেওয়া যেতে পারে। হাইকোর্ট তাকে বাবা-মার সাথে গিয়ে বাস করার নির্দেশ দেয়।

হাদিয়ার স্বামী এ আদেশের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করেন। সুপ্রিম কোর্ট হাদিয়ার কেসসহ আন্তঃধর্ম বিবাহ বিষয়ক তদন্তের জন্য কেন্দ্রীয় সন্ত্রাস দমন প্রতিষ্ঠান ন্যাশনাল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সি (এনআইএ)-কে নির্দেশ প্রদান করে। পরবর্তীতে সুপ্রিম কোর্টের তিন সদস্যের বেঞ্চ হাদিয়াকে তলব করে এবং সে কি চায় তা জানতে চায়। হাদিয়া জবাব দেয়, আমি আমার স্বামীর সাথে যেতে চাই। কেউ আমাকে মুসলমান হতে বাধ্য করেনি।

হাদিয়া আশংকা প্রকাশ করে যে, তার বাবা-মা তার পড়াশোনা চালিয়ে যেতে দেবে না। সুপ্রিম কোর্ট হাদিয়াকে কলেজে যাবার অনুমতি দেয়। ২৩ জানুয়ারি তিন সদস্যের বেঞ্চ তাদের অবস্থান পুনঃনির্ধারণ করে বলে হাদিয়ার মস্তিষ্ক ধোলাই করা হলেও এতে কারো করার তেমন কিছু নেই। তারা বলেন, এটা তার স্বাধীন সিদ্ধান্ত হোক বা না হোক, সেই তা জানে। আমরা এতে নাক গলাতে পারি না। যদি সে আদালতে আসে ও বলে সে নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করেছে, সেখানেই ব্যাপার শেষ। সর্বশেষ সুপ্রিমকোর্ট হাদিয়ার বিয়েকে বৈধতা দেয় এবং হাদিয়া জয়ী হয়।

মুসলিম ঐতিহ্যবাহী ঐতিহাসিক স্থান ও স্থাপনার নাম পরিবর্তনের হিড়িক

ঐতিহাসিক বিভিন্ন স্থান ও স্থাপনার মুসলিম ঐতিহ্যবাহী নাম বদলের হিড়িক চলছে সারা ভারতজুড়ে। বিভিন্ন ঐতিহাসিক অঞ্চলের নাম পরিবর্তির হচ্ছে। হিন্দুত্ববাদকে আঁকড়ে রাখতে এবং সামনের লোকসভা নির্বাচনে হিন্দুত্ববাদকে আরও বেশি প্রচারে রাখার জন্যই ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি এই কাজ করছেন বলে মনে করা হচ্ছে।

ভারতের উত্তরপ্রদেশ রাজ্যে অবস্থিত এলাহাবাদ শহরের নাম পাল্টে প্রয়াগরাজ করার পর এখন সেই তালিকায় রয়েছে বেশ কয়েকটি ঐতিহাসিক শহরের নাম, যেগুলোর সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে মুসলিম ঐতিহ্য। হায়দাবাদের নাম পাল্টে ভাগ্যনগর করার দাবি জানালেন তেলঙ্গানার এক বিজেপি নেতা। তার দাবি, মুসলিম শাসকেরাই এই শহরের নাম ভাগ্যনগর থেকে হায়দ্রাবাদ করে দিয়েছিলেন। অবশ্য শুধু হায়দ্রাবাদই নয়, বিজেপির নজরে আছে সেকেন্দারবাদ এবং করিমনগরের মতো আরও বেশ কয়েকটি জায়গাও। ক্ষমতায় এলে একে একে সব নাম বদলে ফেলা হবে বলে জানিয়েছেন এই বিজেপি নেতা।

শুধু তেলঙ্গানা বা উত্তরপ্রদেশ নয়, গোটা ভারতজুড়েই এখন চলছে নাম বদলে দেয়ার ট্রেন্ড। ফৈজাবাদ হয়েছে অযোধ্যা। গুজরাটের আহমেদাবাদের নাম বদলে কর্ণাবতী করার প্রস্তাবও সামনে এসেছে। আগ্রা শহরের নামও অগ্রভন করার দাবি উঠেছে ইতিমধ্যেই। সেই তালিকাতেই নতুন সংযোজন এবার হায়দ্রাবাদ।

নাম পরিবর্তনের তালিকায় যোগ হয়েছে তাজমহলের শহর আগ্রাও। আগ্রার এক বিজেপি বিধায়ক জগন প্রসাদ গর্গ দাবি করেছেন, আগ্রা নামের কোন মানে হয় না। তাই এই নাম পরিবর্তন করে অবিলম্বে অগ্রভন করে দেওয়া উচিত।

এ হচ্ছে ফিরে দেখা গুজরাট দাঙ্গার অন্যতম নেতা, ‘গুজরাটের কসাই’খ্যাত মোদির ভারত শাসন। ২০১৯ সালে আবারও ক্ষমতায় আসতে একই পথে হাঁটছে বিজেপি। বিজেপি বিজয়ী হলে ভারতের এই পরিস্থিতি বাড়তেই থাকবে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করছেন বিশ্লেষকরা। ভারত, ভারতের শান্তিপ্রিয় অহিংস মানুষেরা কি পারবে ভারতকে ইতিহাসের এই কালিমালিপ্ত শাসনের হাত থেকে মুক্তি দিতে?

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন